অরুণ কুমার চৌধুরী:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বেঁচে থাকলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু হতেন শতবর্ষী। আবার চলতি বছর উদযাপিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতক তথা সুবর্ণজয়ন্তী। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ সময়কালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
মুজিববর্ষকে সামনে রেখে সরকারের সঙ্গে আত্তীকৃত হয়ে বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনও (বিএইচবিএফসি) গ্রহণ করেছে নানা পরিকল্পনা। ১৯৫২ সাল থেকে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধানে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থাটি আর্থিক-ঋণ সহায়তা প্রদান করে আসছে।
১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির ৭নং আদেশ বলে প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠিত হয়। তখন থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ার অংশীদার হিসাবে গৃহায়ণ খাতে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিএইচবিএফসি ঋণ সহায়তা প্রদান করে আসছে।
রূপকল্প-২০২১-এ বর্ণিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত ‘সবার জন্য আবাসন’ কর্মসূচি এবং সমন্বিত ও টেকসই জনবসতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধান, আবাদি জমি রক্ষা, সবুজ অর্থায়ন এবং গ্রামীণ পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহরে উন্নীতকরণে বিএইচবিএফসি তার ঋণ কার্যক্রমকে ঢেলে সাজিয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ঋণের সিলিং, কমানো হয়েছে ঋণের সুদের হার। ফলে যেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সিটিতে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে ঋণ বিতরণের হার ছিল ৭৯ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলে ২১ শতাংশ, সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সিটি বাদে দেশের অন্যান্য গ্রামীণ অঞ্চলে ৬৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম দর্শন ছিল-‘বাংলার কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না’। তার এই দর্শন-স্বপ্ন সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। ২৩ জানুয়ারি ২০২১ একযোগে ৭০ হাজার গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি উপহার দিয়ে তাদের নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। দিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন।
একইভাবে সারা দেশে ৯ লাখ মানুষকে জমিসহ পাকাঘর করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মুজিববর্ষে গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য এটি প্রধানমন্ত্রীর উপহার। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক বিরল দৃষ্টান্ত। একটি ঘর বা আবাসন শুধু একটি আশ্রয়স্থল নয়। যার কিছুই ছিল না, এ ঘরটি তার বেঁচে থাকার স্বপ্ন; তার সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও আত্মমর্যাদার নিদর্শন।
সবার জন্য আবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে ‘মুজিববর্ষের সম্ভাষণ-সবার জন্য আবাসন’ এই স্লোগান ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয়ে সব শ্রেণির মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা বাড়ি নির্মাণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঋণের প্রোডাক্ট চালু, ঋণ সেবা সহজীকরণসহ দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধান এবং জীবনমান উন্নয়নে বিএইচবিএফসি প্রবর্তন করেছে ‘জিরো ইকুইটি আবাসন ঋণ’।
গ্রামীণ অবকাঠামোতে স্বাস্থ্যসম্মত, দূষণমুক্ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং পরিবেশবান্ধব উপকরণগুলো, বিশেষত সৌরবিদ্যুৎ, স্যানিটেশন ও বৃক্ষশোভিত মডেলের বাড়ি তৈরিকে উদ্বুদ্ধ করে এ ঋণ প্রদান করা হয়।
মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বিএইচবিএফসি কর্তৃক জিরো ইকুইটিতে বাড়ি নির্মাণে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আবাসন সমস্যার সমাধান, আবাদি জমি রক্ষা এবং গ্রামীণ পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামকে শহরে উন্নীতকরণে এ ঋণ কার্যকর প্রভাবক হিসাবে ভূমিকা রাখবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকা বাদে দেশের অন্যান্য এলাকায় বাড়ি নির্মাণের জন্য ‘জিরো ইকুইটি আবাসন ঋণ’ প্রোডাক্ট চালু করা হয়।
বিএইচবিএফসি কর্তৃক সরবরাহকৃত নির্দিষ্ট ডিজাইন অথবা গ্রাহকের নিজস্ব ডিজাইন মোতাবেক ৬০০-৯০০ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট একতলা বাড়ি নির্মাণে কৃষক আবাসন ঋণ ও পল্লীমা ঋণের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৭ ও ৮ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ১৬.৫০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এতে গ্রাহকের নিজস্ব বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। গ্রাহকের কমপক্ষে ৪ শতক নিষ্কণ্টক জমি এবং ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধের ন্যূনতম সক্ষমতা থাকা সাপেক্ষে খুব সহজেই এ ঋণ পাওয়া যাবে।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত ও দৃষ্টিনন্দন আবাসন, পল্লী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং নির্মাণ উপকরণ ব্যবসা সম্প্রসারণ, সর্বোপরি পল্লী অবকাঠামোর সার্বিক উন্নয়ন এবং ‘শেকড়ের সন্ধানে পল্লী’ বাস্তবায়নে এ ঋণ মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে, যা গ্রামীণ অর্থনীতি এবং দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বিএইচবিএফসির প্রয়াত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী মুজিববর্ষে সরকার ঘোষিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার সঙ্গে বিএইচবিএফসিকে সম্পৃক্ত করেছিলেন এ ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে। এই ঋণ প্রবর্তনে তিনি হাতে নিয়েছিলেন নানা উদ্যোগ।
বিশেষত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, পরিপত্র জারি, দ্রুত নথি প্রক্রিয়াকরণে নানাবিধ নির্দেশনা, প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিয়েছিলেন কার্যকর পদক্ষেপ। মুজিববর্ষে বিএইচবিএফসিকে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানে বিস্তৃত করেছিলেন তিনি। তার এ স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন বিএইচবিএফসির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অরুণ কুমার চৌধুরী : ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব), বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন